যযাতির জরা (শ্রীকৃষ্ণ ও অভিশাপের পর) – অতনু দাশ গুপ্ত

কেন শ্রীকৃষ্ণ যদুকুলের শিরোমণি হয়েও কখনো সিংহাসনে আরোহন করতে পারেননি তা সবাইকে এর আগের লেখায় অবহিত করেছিলাম। আজ দেখবো এর উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল।  শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং তার সখী শর্মিষ্ঠার সখ্যতার মাঝে চলে আসেন রাজা যযাতি। দেবযানী এবং যযাতির বিবাহ হওয়ার পর শর্মিষ্ঠাও মনে মনে রাজাকে নিজের পতিরূপে বরণ করেন। একসময় তার প্রার্থনা রাখতে পুত্রবতী করেন শর্মিষ্ঠাকে। যথাসময়ে যদু ও তুর্বসু নামে দেবযানীর দুই পুত্র এবং দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু নামে শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র জন্ম হয়।

 

একদিন দেবযানী রাজা যযাতি এবং শর্মিষ্ঠার সন্তানাদির কথা অবগত হন। এতে স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ, রাগান্বিত হয়ে পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে যথোপযুক্ত ধর্ম প্রার্থনা করেন। তখন ক্রুদ্ধ পিতা যযাতিকে অভিশাপ দেন, -“মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়েও অধর্ম করেছ। আমার উপদেশ গ্রাহ্য করনি। অতএব দুর্জয় জরা তোমাকে আক্রমণ করবে।”

শিরে সংক্রান্তি দেখে যযাতি শাপ প্রত্যাহারের জন্য আকুতি জানালে তিনি বলেন, তার শাপ মিথ্যা হবে না! তবে মহারাজ চাইলে নিজের জরা অন্য কাউকে দিতে পারেন।

তখন যযাতি নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে জরা গ্রহণ করার জন্য  বললেন।  যদু জানান, “জরায় অনেক কষ্ট, আমি নিরানন্দ শ্বেতশ্মশ্রু লোলচর্ম দুর্বলদেহ অকর্মণ্য হয়ে যাব। আমার চেয়েও প্রিয়তর পুত্র আপনার আরও আছে, তাদের বলুন।”

মনঃক্ষুণ্ন হয়ে যযাতি বললেন, “আত্নজ হয়েও যখন আমার অনুরোধ রাখলে না তখন তোমার সন্তান রাজ্যের অধিকারী হবে না।”

 

তারপর একে একে তিনি তুর্বসু, দ্রুহ্যু, অনুকে অনুরোধ করলেন। কেউই জরা নিয়ে যৌবন দিতে সম্মত হলেন না। যযাতি তুর্বসুকে বংশলোপের শাপ দিলেন, অন্ত্যজ ও শ্লেচ্ছ জাতির রাজা হবেন।  দ্যুহ্যুকেও দূর্গম দেশে দেশান্তরি হওয়ার শাপ দিয়ে বললেন তার কখনও অভীষ্ট লাভ হবে না। আর অনুকে আরও ভয়াবহ – তাঁর সন্তানাদি যৌবন লাভ করেই মরবে এমন শাপ দিলেন। এমনকি তাঁকে  অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়াহীন হওয়ারও শাপ দিলেন।

 

অতএব এখন বাকি রইলেন পুরু। তিনি সানন্দে সম্মত হয়ে পিতাকে বললেন, “মহারাজ, আমার যৌবন নিয়ে অভীষ্ট সুখ ভোগ করুন, আপনার জরা আমি নেব। যযাতি প্রীত হয়ে পুরুর রাজ্যে সকল প্রজার সমৃদ্ধি লাভের জন্য আর্শীবাদ করলেন।

 

পুত্র পুরুর যৌবন পেয়ে যযাতি অভীষ্ট বিষয় ভোগ, প্রজাপালন এবং বহুবিধ ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। সহস্র বছর গত হলে তিনি পুরুকে একদিন বললেন, ” পুত্র, তোমার যৌবন লাভ করে আমি ইচ্ছানুসারে বিষয় ভোগ করেছি –

 

“ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।

হবিষা কৃষ্ণবত্নের্ব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।

যৎ পৃথিব্যাং ব্রীহিযবং হিরণ্যং পশবঃ স্ত্রিয়ঃ।

একস্যাপি ন পর্যাপ্তং তস্মাৎ তৃষ্ণাং পরিত্যজেৎ।।”

 

– কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃত সংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে যত ধান্য,যব, হিরণ্য, পশু ও স্ত্রী আছে তা একজনের পক্ষেও পর্যাপ্ত নয়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করা উচিত।”

 

এরপর যযাতি বললেন, পুরু আমি প্রীত হয়েছি। তোমার যৌবন ফিরে নাও,আমার রাজ্যও নাও। তখন ব্রাহ্মণাদি প্রজারা আপত্তি করলেও মহারাজ সবাইকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে বাকিরা কেউ-ই তাঁর আদেশ পালন করেনি। পুরু করেছে তাই রাজ্য তাঁরই প্রাপ্য। যযাতি রাজ্য পুরুর কাছে সমর্পণ করে বনে গমন করেন। সেখানে তপস্যায় রত হন।

এরপর দেহত্যাগের পর সুরলোকে প্রস্হান করেন।

 

পুরুর বংশেই জন্মগ্রহণ করেন রাজা দুষ্মন্ত। শকুন্তলা এবং দুষ্মন্তের গল্পের উৎপত্তি মূলত এই জায়গা থেকেই।

 

পরবর্তী পর্বে (শ্রীরাম ও তারার অভিশাপ)