দ্বাপরযুগের শিরোমণি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি সে যুগকে ধর্মের যুগের আখ্যা দেয়। দুই পদ ধর্ম, দুই পদ অধর্ম। তাঁর জীবনের অত্যন্ত আশ্চর্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার ছিল অভিশাপ গ্রহণ! তিনি তা মেনেও চলেছেন। স্বয়ং সর্বশক্তিমান মনুষ্য শরীর ধারণ করলেও নিজ কর্মফল ভোগ করা বা মেনে চলায় তিনি কোন অনিয়ম করেননি। নিজেকেও তিনি ক্ষমা করেননি, তাঁর মাতাকেও নয়, সেখানে আমরা কোন ছাড়??
শ্রীকৃষ্ণ কখনো রাজা হতে পারেননি এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কেউও নয়। প্রশ্ন হলো কেন??
এর উত্তর লুকিয়ে আছে মহাভারতের আদি পর্বে।
রাজা যযাতি – শর্মিষ্ঠা– দেবযানীর উপাখ্যানে।
পুরো গল্প এখানে বলা সম্ভবপর নয়। এর জন্য আগ্রহীগণ অবশ্যই মহাভারতের আদি পর্বে ‘যযাতির জরা‘ পড়তে পারেন। যযাতি (রাজা নহুষের পুত্র) শুক্রাচার্যের (অসুরগণের গুরু) অভিশাপে তাঁর যৌবন হারান। শীঘ্রই জরা তাঁকে গ্রাস করবে। এমতাবস্থায় তিনি অভিসম্পাত ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করলে শুক্রাচার্য জানান তাঁর কথা কখনো বিফলে যাবে না তবে যদি যযাতির পুত্রদের কেউ জরা গ্রহণ করতে সম্মত হন তবে তিনি যৌবন পুনরায় ফিরে পাবেন।
তখন নিরুপায় যযাতি পুত্রদের অনুরোধ করেন। জৈষ্ঠ পুত্র যদুকে বললে তিনি প্রত্যাখান করেন – “জরায় অনেক কষ্ট, আমি নিরানন্দ শ্বেতশ্মশ্রু লোলচর্ম দুর্বলদেহ অকর্মণ্য হয়ে যাব, যুবক সহচররা আমাকে অবজ্ঞা করবে। আমার চেয়ে প্রিয়তর পুত্র আপনার আরও তো আছে,তাদের বলুন।“
পিতা যযাতি পুত্রকে অভিশাপ দিলেন, আত্মজ হয়েও যখন আমার অনুরোধ রাখলে না তখন তোমার সন্তান রাজ্যের অধিকারী হবে না! “
মূলত এখান থেকেই কৃষ্ণের যদুকুলের সিংহাসনের প্রতি চির অনিহার সৃষ্টি হয়। তাঁরই পূর্বপুরুষ যদু পিতা যযাতি কর্তৃক শাপগ্রস্ত হওয়ায় পরবর্তীতে আর কেউ–ই রাজ্যের সিংহাসনে উপবিষ্ট হতে পারেননি।
এই অভিশাপ চিরস্থায়ী হয়েছিল। তিনি নিজে রাজসভার প্রধান ব্যক্তিদের একজন ছিলেন অথচ কোনদিন রাজা হননি, এমনকি তাঁর পরবর্তী বংশধরেরাও নয়।
শ্রীকৃষ্ণ আরও অনেক শাপ বিনাবাক্যে গ্রহণ করেছেন কারণ তিনি জানতেন এটা মহাকাল আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। যেমনটা রাম চরিত্রেও দেখা যায়। বালী বধের পর তারা কর্তৃক রামের শাপ গ্রহণ।
গান্ধারী এবং কৃষ্ণের সম্পর্কেও একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়।কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী প্রতিহিংসার পরিণামে শতপুত্রের সকলকেই হারান গান্ধারী। তখন পুত্রদের শবদেহ নিয়ে বিলাপরত গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেন, এমন করুণ দশার কারণ কি?
উত্তরে কেশব বলেন, গান্ধারীর পূর্বজন্মে খেলার ছলে তিনি একশত পতঙ্গের প্রাণ নাশ করেছিলেন। তারই প্রতিফলসরূপ আজ তাঁর একই পরিণাম। গান্ধারী এক্ষেত্রে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এটা বলে, তিনি নাবালিকা হওয়ায় প্রাণনাশের বিষয়টি অবগত ছিল না। শত পতঙ্গকে হত্যা করা অবশ্যই মহাপাপ কিন্তু সেটা না বুঝেই ওই বয়সে করেছেন। এর জন্য তাঁকে লঘু পাপে গুরু দন্ড দেওয়া হয়েছে।
প্রতিউত্তরে মধুসূদন জানান, শত পতঙ্গের মৃত্যু শত পতঙ্গের মা জননীকে ব্যথিত, পীড়িত, ক্রন্দিত করেছিল। তাঁরাই এ অভিশাপ দিয়েছেন। এতে গোবিন্দের শাস্তি প্রদানের কোন বিষয় নেই। তিনি চাইলেও এ ফল প্রদানে বাঁধা প্রদান করতে পারেন না! স্বয়ম্ভু হওয়া সত্ত্বেও!
কিন্তু গান্ধারীর ওই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেও দূর থেকেই দিব্যচক্ষুর সাহায্যে সেই ভয়াবহ করুণ দৃশ্য দেখতে লাগলেন। পুত্রদের দেহাবশেষ দর্শন বা অনেকের শবদেহের খোঁজও না পাওয়া পুত্রবধুদের ক্রন্দন পরিস্থিতিকে অনেক গম্ভীর করে তোলে।
“আমার পতিপুত্রহীনা পুত্রবধূরা আলুলায়িতকেশে রণভূমিতে ধাবিত হচ্ছেন। মস্তকহীন দেহ এবং দেহহীন মস্তক দেখে অনেকে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেছেন। ওই দেখ, আমার পুত্র বিকর্ণের তরুণী পত্নী মাংসলোভী গৃধ্রদের তাড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। কৃষ্ণ, তুমি নারীদের দারুণ ক্রন্দনের নিনাদ শোন। শ্বাপদগণ আমার পুত্র দুর্মুখের মুখমন্ডলের অর্ধভাগ ভক্ষণ করেছে। কেশব, লোকে যাঁকে অর্জুন বা তোমার চেয়ে দেড়গুণ অধিক শৌর্যশালী বলত ােই অভিমন্যুও নিহত হয়েছেন, বিরাটদুহিতা বালিকা উত্তরা শোকে আকুল হয়ে পতির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। উত্তরা বিলাপ করে বলছেন, বীর, তুমি আমাদের মিলনের ছয় মাস পরেই নিহত হলে! ওই দেখো, মৎস্যরাজের কুলস্ত্রীগণ উত্তরাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হায়! কর্ণের স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ভূতলে পড়ে গেছেন! শ্বাপদগণ কর্ণের দেহের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে। গৃধ্র ও শৃগালগণ সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের দেহ ভক্ষণ করছে, আমার কন্যা দুঃশলা আত্মহত্যার চেষ্টা করছে এবং পান্ডবদের গালি দিচ্ছে। হায়, ওই দেখো দুঃশলা পতির মস্তক না পেয়ে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। ওইখানে উধ্বরেতা সত্য প্রতিজ্ঞ ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে রয়েছেন। দ্রোণপত্মী কৃপী শোকে বিহ্বল হয়ে পতির সেবা করছেন, জটাধারী ব্রাহ্মণগণ তাঁর চিতা নির্মাণ করছেন। কৃষ্ণ, ওই দেখো, শকুনির দেহকে শকুনেরা ঘিরে রেখেছে, ওই দুর্বুদ্ধীও অস্ত্রাঘাতে নিধনের ফলে স্বর্গে যাবে।
তারপর গান্ধারী বললেন, মধুসূদন, তুমি কেন এ যুদ্ধ হতে দিলে?? তোমার সামর্থ্য ও বিপুল সেনা ছিল, সকলেই তোমার কথা শুনতো। তথাপি তুমি দু‘কুলের এ বিনাশ উপেক্ষা করেছো। তোমাকে এর ফল ভোগ করতে হবে। পতির শুশ্রূষা করে যে পূণ্য আমি অর্জন করেছি তার বলে তোমাকে শাপ দিচ্ছি, তুৃমি যেমন কুরুপান্ডবের জাতির বিনাশ উপেক্ষা করেছো তেমনি তোমার জাতিগণকেও তুমি বিনষ্ট করবে। ছত্রিশ বছর পরে তুমি জাতিহীন, অমাত্যহীন, পুত্রহীন ও বনচারী হয়ে অপকৃষ্ট উপায়ে নিহত হবে। আজ যেমন ভারতবংশের নারীরা ভূমিতে লুন্ঠিত হচ্ছে, তেমনি তোমাদের নারীরাও হবে।
মহামনা বাসুদেব ঈষৎ হাস্য করে বললেন, “দেবী, আপনি যা বললেন তা আমি জানি; যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্যই আপনি শাপ দিলেন। বৃষ্ণিবংশের সংহারকর্তা আমি ভিন্ন আর কেউ নেই। যাদবগণ মানুষ দেবদানবের অবধ্য, তারা পরস্পরের হস্তে বধ্য হবেন। “
(যযাতির জরা পরবর্তী পর্বে)
তথ্যসূত্র –
- মহাভারত – রাজশেখর বসু
- কৃষ্ণ ও কুরু -পান্ডবের উৎস – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী