বিয়াল্লিশ দুই এ চুয়াল্লিশ, পাঁচ এ ঊনপঞ্চাশ আর এই এক এ পঞ্চাশ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে টাকা গুলো কে সযত্নে ঝুলির মধ্যে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা ভিখারী মা। মাথা টা কি একটু ঘুরে গেল ? তা মাথার আর দোষ কি, সকাল থেকে কালুর দেওয়া একভার চা আর 2 তো মেরি বিস্কুট ছাড়া পেটে তো কিছু পড়েনি, এই lockdown এর বাজারে পঞ্চাশ টাকা জোগার করতেও অনেক কাঠখড় পড়াতে হয়েছে তাকে, তার পর পরশু জুতোর ফিতে টাও চিরে যায়, হাটতে চলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। একে এই ইংরেজ আমলের বৃদ্ধ শরীর তার ওপর এত পরিশ্রম , আর যেন সহ্য হয় না। সত্যি ইংরেজ আমল ই বটে, তখন কত বয়স হবে, ঠিক মনেও পরে না, তবে মায়ের মুখে শুনেছে অনেক বার। দাদার বন্ধু রা খুলনা থানা লুট করলো বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে, দাদা তা পুলিশের গুলিতে মরলো, দাদার এক বন্ধু রাতে লুকিয়ে ছিল তার ঘরে, দোর আগলে দাঁড়িয়ে বছর আস্তেকের মেয়ে টা, সে কি রুপ তার, সেদিন গোরা পুলিশ ও তাকে সরিয়ে অন্দরে ঢুকতে পারেনি…“ধূম্রনেত্র বধে দেহি, ধর্ম কামার্থ দায়িনী, রুপাং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি, দ্বিষ জহি” মাইকের আওয়াজে চিন্তায় ছেদ পড়লো বুড়ির। এই গল্প করেছে ও সে অনেককে, বিশ্বাস তো কেউ করেই নি, ফল হয়েছে উল্টো, ছেলে ছোকরা রা প্রায়ই টিটকিরি দেয়, কিগো দিদা তুমি না কি ইংরেজ তাড়িয়েছিলে? তা কি দিয়ে তাড়ালে, তোমার ওই লাঠি দিয়ে। লাঠিটা দাদুর, মনে আছে বুড়ির, ভিটে ছেড়ে আসতে কি চাইনি দাদু, বাবার হাতে লাঠিটা তুলে দিয়ে বলেছিল, এই রইলো আমার আশীর্বাদ, তোর মা কে হারিয়েছি, এই ভিটে আমি হারাবনা, তুই বউ মেয়ে কে নিয়ে পালা। হ্যা, ওপর বাংলা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল ওদের, বাবা মিল এ চাকরি পেল, ওর বিয়ে হলো সেই কল এরই এক কর্মচারীর সাথে, ছেলে হলো, ছেলের ও বিয়ে দিয়েছিল বুড়ি মহা ধুমধামে। মোটর গাড়ি কিনেছিল সেই ছেলে , তখন তার বউ ভরা পোয়াতি, গাড়ি তে করে ফিরছিল তারা, কিন্তু বুড়ির কপালে সুখ সয় না, গাড়ির accident হলো, ছেলে বউ মারা গেল কিন্তু কোন আশ্চর্য্য বলে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পেরেছিল ডাক্তারেরা। তাকে অবলম্বন করেই শুরু হয়েছিল বুড়ির বাঁচার নতুন লড়াই।
“ও মা , ও বুড়ি মা”
“ কে কালু”
“ হ্যা গো, এই তুমি নাকি বিকেলে পুজো দেবে বলেছিলে, তা কৈ, সন্ধ্যে হয়ে গেল, যাবেনা”
“হ্যাঁ রে বাবা নিয়ে চ, এ বেলা পুজো টা দিয়ে আসি”
“ তোমাকেও বলিহারি, কি যে এত ঠাকুর ঠাকুর করো, সে তো তোমার এই অবস্থা করে রেখেছে, তার পরেও এতো ভক্তি কোথা থেকে আসে বুঝিনা বাপু”
“খবদ্দার কালু, তোর না নিয়ে যেতে হয় না যাবি, একদম এরম কথা বলবি না,আমার বাছার অমঙ্গল হবে”. . দপ করে জ্বলে ওঠে প্রৌঢ়ার চোখ, সে দৃষ্টিতে এমন কিছু একটা ছিল যার সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় বুড়ির ঝুপরির পাশের চা দোকানি কালু ওরফে কালিপদ ওঝা। বুড়ির হাত ধরে নিয়ে যায় আমরা কজন পূজা কমিটির সার্বজনীন দুর্গোৎসব এর প্যান্ডেল টির দিকে।
প্যান্ডেলটা একটা নাটমন্দির কে ঘিরে বানানো, যেখানে বহুকাল ধরে ছিল বুড়ি আর তার নাতির বাস, আগের বার covid বিধি মেনে পুজো করতে গিয়ে, ক্লাব এর আগের পুজোর জায়গা টা ঠিক মনমতো হয় না ক্লাব কর্তিপক্ষের, তাই এই নাটমন্দির টাকে কেন্দ্র করে খোলা মেলা পুজোর আয়োজন। আর সেখানেই মাথার উপরের ছাদ টা চলে গিয়েছিল বুড়ি আর তার নাতির।
আসলে জন্মের বছর তিনেক পরে জানা যায় বাচ্চাটার মাথা জন্মের সময় একটা ছোট আঘাত এর জন্য স্বাভাবিক পরিণতি পাবে না, তবে হাল ছাড়েনি তার ঠাকুমা, অনেক বছর অনেক টাকা খরচ করেছে, বসত ভিটেটাও সেই খাতেই চলে গেছে, কিন্তু ঠাকুর মুখ তুলে চাইনি। তার পর থেকেই নাটমন্দির তাই হয় তাদের নতুন ঠিকানা, আর ভিক্ষাবৃত্তি হয় নতুন পেশা। তাও নাতি ঠাকুমায় বেশ ভালোই ছিল, দুবেলা দুমুঠো কোনো রকমে জুটে যাচ্ছি, বাঁধ সাধলো এই কি একটা virus, পুজোর সময় নাটমন্দির এর জঞ্জাল সাফ হলো, আর ডাস্টবিনে র পাশের একটা পলিথিন এর চালায় পুনর্বাসন হলো বুড়ি আর তার নাতির। মহালয়ার আগের দিনের বৃষ্টিতে উড়ে গেল সেই পলিথিন, বৃষ্টিতে ভিজে প্রবল জ্বর বাধলো বছর 24 এর বাচ্চাটির, ঠাকুমার অনেক অনুরোধেও করোনা বিলাসী এই সমাজ দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল ঝুপরিবাসী এই অসহায় রোগিটির, ঠাকুমার কোল খালি করে ছেলে গেল সে।
তার পর থেকে সেই পলিথিনের চালা জুড়ে একই বাস করে এই বুড়ি ভিখারী মা। অনেক হারিয়েও ঠাকুরের প্রতি আস্থা হারায়নি সে, মনে মনে ঠাকুর কে সে আজও জানায়, মা ও মা, তুমি তো সবার কথা শোনো, কিছু চাইনা আমার, টাকা চাইনা, বাড়ি গাড়ি কিছু চাইনা, খাবার ও চাইনা মাগো। আগের বার তো আমার কথা শুনলি না তুই, আগের বারে পুজোর প্রতিদিন তোর কাছে 25 টাকা করে পুজো দিয়েছিলাম, এবার মা 50 টাকা করে দেব, আরো কিছু টাকা জমিয়েছি মা, শাড়ি কিনে দেব সন্ধি পুজোয়, এবারে আমার কথা টা রাখিস, আমাকেও তুলে না মা– অনেক দিন দেখিনি দাদুভাই কে, আমি যাবো ওর কাছে, আমি ছাড়া কেউ নেই মা ওর , আর ও ছাড়া আমার ও কেউ নেই, তুলে নে মা, তুলে —–, ঠাকুরের বেদির সামনে জ্ঞান হারায় বুড়ি।
“ওই দেখো আবার, আচ্ছা জ্বালা হয়েছে আমার” বিরক্ত মুখে কালু কোলে তুলে নেয় বুড়িকে, আবার একটা দিন কাটে, পলিথিন এর চলা থেকে আবার ভেসে আসে একটা মৃদু কণ্ঠস্বর, একুশ দুই এ তেইশ, এক এ চব্বিশ।